সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১২:৫২ পূর্বাহ্ন

উচ্চ আদালতে বাড়ছে জনস্বার্থের মামলা

উচ্চ আদালতে বাড়ছে জনস্বার্থের মামলা

স্বদেশ ডেস্ক:

দুধে ভেজাল, পানিতে দূষণ, পরিবেশ দূষণ, গ্যাসের দামবৃদ্ধি, নদীদখল ও দূষণ রোধ, খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ঠেকানো এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে জনস্বার্থে মামলা হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার রক্ষায় এ ধরনের মামলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা কখনো পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আবার কখনো কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট (পিআইএল) করছেন। উচ্চ আদালত এসব মামলা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে প্রতিকার দিতে এগিয়ে আসছেন। কখনো কখনো স্বতঃপ্রণোদিত আদেশও দিচ্ছেন। ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ তাদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে পারছেন।

জনস্বার্থের মামলা বৃদ্ধির ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশ যত উন্নত হবে, জনগণও তত সচেতন হবে। জনস্বার্থে মামলা বৃদ্ধি জনগণের সচেতনতারই ফসল।’ অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, জনস্বার্থের মামলায় দেখতে হবে প্রকৃতপক্ষে কোনো জনস্বার্থ জড়িত আছে কিনা। না কি সরকারকে বিব্রত করতে বা অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ে করছে। এগুলো বিবেচনা করেই আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

আইনজীবীদের মতে ,‘জনস্বার্থের মামলা’ প্রথম চালু হয় আমেরিকায় ১৯৬০ সালে। ’৯০-এর দশকে এ উপমহাদেশেও এ ধরনের মামলার সূত্রপাত ঘটে। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আলোচিত জনস্বার্থের মামলাটি হচ্ছে ‘মহিউদ্দিন ফারুক বনাম রাষ্ট্র’। ১৯৯৬ সালে করা এ মামলা ফ্যাপ-২০ (পরিবেশবিষয়ক) মামলা নামেও পরিচিত। এ মামলায় একটি বিতর্কিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের ফলে একটি বিশেষ এলাকার পরিবেশে সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল। এ মামলার রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে জনস্বার্থমূলক মামলা করার আনুষ্ঠানিক দ্বার খুলে যায়। আপিল বিভাগ এ মামলায় বলেন, সংক্ষুব্ধ

 

কথাটি শুধু ব্যক্তিগতভাবে অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় না; বরং এটি জনসাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত। তার মানে ‘সংক্ষুব্ধ’ বলতে জোটবদ্ধ বা সমষ্টিগত ব্যক্তিকে বোঝায় না; বরং যে কেউই সংক্ষুব্ধ হতে পারে। এ মামলার মাধ্যমেই বাংলাদেশে পিআইএলের আনুষ্ঠানিক বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতি মেলে এবং একটি সুসংগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারা গড়ে ওঠে।

সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে পিআইএলের সংখ্যার আলাদা কোনো হিসাব নেই। তবে পর্যায়ক্রমে দিন যত গড়িয়েছে, ততই এ ধরনের মামলা বেড়েছে। এখন এ ধরনের মামলার কারণে অনেক সময় বিচারপতিদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। তার পরও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে প্রতিকার দেওয়ায় বিচারপ্রার্থীরা খুশি। এ দেশে মূলত যেসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনস্বার্থের মামলা করা হয়, সেগুলো হচ্ছেÑ হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন ছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু সংগঠন এ ধরনের মামলা করছে। এ ছাড়া সুপ্রিমকোর্টের বেশ কয়েকজন আইনজীবী ব্যক্তিগতভাবেও এ ধরনের মামলা করে থাকেন।

এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবং পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন এইচআরপিবির প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘আগে জনস্বার্থের মামলা কম ছিল। কারণ যারা এ ধরনের মামলা করত, তারা ছিল বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও। বিদেশি ফান্ডের ওপর ভিত্তি করে জনস্বার্থের মামলাগুলো করত। কিন্তু ২০০৬-০৭ সাল থেকে এই বিদেশি ফান্ডের বাইরে থেকে যখন নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করলাম, তখন এর ব্যাপ্তি লাভ করেছে। এখন ব্যক্তিগতভাবে অনেক আইনজীবী এগিয়ে এসেছেন। ফলে এ ধরনের মামলার সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার আদালতও বেশ পজেটিভলি হস্তক্ষেপ করছে।’

কেন এ ধরনের মামলার প্রয়োজন হয়Ñ এমন প্রশ্নে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘মূলত প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে জনস্বার্থে রিট মামলার প্রয়োজন পড়ে। আইন বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা থাকলে বা প্রশাসনের পদক্ষেপ গ্রহণে নিষ্ক্রিয়তা দেখা দিলে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে এ ধরনের মামলা করতে হয়। তবে মামলা দায়ের ও উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ বাড়লেও এখনো এসব মামলায় দেওয়া আদেশ পালনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য রয়েছে বলে মনে করেন এ আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আদেশ বাস্তবায়নের জন্য লেগে থাকতে হয়। তা হলে একদিন না একদিন আদেশ বাস্তবায়ন হবেই।’

সংবিধানের ২৭ থেকে ৪৩ অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে আইনের দৃিষ্টতে সমতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জীবনের অধিকার, ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমাবেশের অধিকার, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা, পেশা বা বৃত্তির অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, গ্রেপ্তার বা আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ ইত্যাদি অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ অধিকারগুলো শুধু রাষ্ট্র ও এর অঙ্গ সংস্থাগুলো লঙ্ঘন করে থাকে। এসব মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ তা বলবৎ এবং বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা করতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের এই এখতিয়ারকে রিট এখতিয়ার বলে। জনস্বার্থে রিটসহ প্রায় পাঁচ ধরনের রিট হয়ে থাকে। মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র লঙ্ঘন করায় রিট মামলাগুলোয় শুধু রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের কোনো সংস্থায় নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পক্ষ করে দায়ের হয়। এ ধরনের মামলা যে কেউ-ই করতে পারে। তবে ক্ষতিপূরণের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকেই করতে হবে বলে হাইকোর্ট সম্প্রতি মতামত দিয়েছেন।

জনস্বার্থে যেসব মামলা হয়েছে : অতিসম্প্রতি দুধে ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টেবায়োটিকসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পানিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও দূষণ, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনস্বার্থে রিট হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের রিটের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়েছে। এর আগে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, খাদ্যের মান বজায় রাখা, খাদ্য আদালত স্থাপন নিয়ে জনস্বার্থে মামলা হয়েছে। যৌন হয়রানি রোধে জনস্বার্থে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি রিট করে ২০০৯ সালে। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সাজসরঞ্জাম সংগ্রহেÑ ঢাকার চার নদী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং বালুকে বাঁচাতে দখল ও দূষণমুক্ত করতে, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারিশিল্প সাভার শিল্পাঞ্চলে সরিয়ে ফেলতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের দেওয়া ভাষণের স্থান ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণকারী স্থানসহ সব ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ করতে, বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ৩০০ রিট হয়েছে। এ ছাড়া ফতোয়া বন্ধে, ভারতে বন্দি বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা, কোরবানির বর্জ্য অপসারণ, ঢাকার বাড়িভাড়া আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন, পতিতাদের পুনর্বাসন, কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকা জরিপ এবং তা সংরক্ষণে জনস্বার্থে রিট হয়েছে। কিন্তু এসব রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া অনেক আদেশ এখনো উপেক্ষিত রয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ ব্যাপারে বলেন, আমার জানা মতে সব আদেশই পালিত হচ্ছে। তবে আদেশ প্রতিপালন হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে একটি মনিটরিং সেল করা যেতে পারে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877